জরুরি মাসয়ালা ও হাদিস

 কোরবানি করতে না পারলে (ফরজ হওয়া ব্যক্তির উপর)


কোরবানির কোনো কাযা নেই। যদি কোরবানির দিনগুলো অতিবাহিত হয়ে যায় এবং অজ্ঞতা, গাফলত অথবা ওজরের কারণে কোরবানি করতে না পারে, তাহলে কোরবানির মূল্য গরিবদের মধ্যে সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। তবে কোরবানির তিন দিনের মধ্যে পশুর মূল্য সদকা করলে ওয়াজিব আদায় হবে না; বরং কোরবানি না করার গুনাহ থেকে যাবে। কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানির জন্যেই চেষ্টা করতে হবে। যদি সম্ভব না হয় এবং কোরবানির দিনসমূহ অতিবাহিত হয়ে যায়, তাহলে মূল্য সদকা করে দিতে হবে। কোরবানি একটি স্বতন্ত্র ইবাদত। অন্য কোনো ইবাদত এর বিকল্প হতে পারে না। যেমন- নামাজ পড়লে রোজা এবং রোজা রাখলে নামাজ আদায় হয় না। এমনিভাবে সদকা দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না। অনেক হাদীস এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল এর দলিল।


কোরবানির পশুতে আকীকার অংশ


সন্তান জন্মগ্রহণের পর সপ্তম দিনে তার মাথার চুল মুণ্ডানো এবং ছেলের জন্যে দুটি ছাগল আর মেয়ে হলে একটি ছাগল জবাই করে দেওয়াকে আকীকা বলে। হানাফী মাযহাবের আলেমদের মতে আকীকা করা মুস্তাহাব। অন্য মাযহাবের কারো কারো মতে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা এবং কারো কারো মতে ওয়াজিব।

মাসয়ালা : কোরবানির বড় পশুতে শরীক হয়েও আকীকা করা জায়েয। 'এক্ষেত্রে আকীকাতে যেখানে একটি ছাগল জবাই করতে হয়, সেখানে গরু, মহিষ ও উটের এক সপ্তমাংশ গ্রহণ করতে হবে। কাজেই মেয়ের আকীকায় এক-সপ্তমাংশ এবং ছেলের আকীকায় দুই-সপ্তমাংশ আবশ্যক। তবে সামর্থ্যের অভাবে ছেলের আকীকায় গরু-মহিষের এক-সপ্তমাংশ গ্রহণেরও অবকাশ আছে।

মাসয়ালা: শিশুর ভরণপোষণ যার দায়িত্ব, আকীকার যিম্মাও তারই। সুতরাং বাবা আকীকা করে দেবে। বাবার সামর্থ্য না থাকলে দাদা করবে। মায়ের সামর্থ্য থাকলে সেও আকীকা করতে পারবে। এদের কারো সামর্থ্য না থাকলে ঋণ করে আকীকা করার প্রয়োজন নেই। অবশ্য অভিভাবকদের বাইরের কেউ যদি আকীকা করে দেয় এবং অভিভাবকরা তাতে সন্তুষ্ট থাকে, তাহলেও আকীকা হয়ে যাবে। পুনরায় করার প্রয়োজন হবে না।

মাসয়ালা : শুধু জীবিত মানুষের আকীকা হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। মৃত সন্তানের আকীকা করার বিষয়টি প্রমাণিত নয়। সুতরাং কোনো সন্তান মরে যাওয়ার পর তার আকীকা করার প্রয়োজন নেই।

মাসয়ালা: কোনো ব্যক্তি বড় হওয়ার পর যদি জানতে পারে যে, মা-বাবা বা অভিভাবক তার আকীকা করেননি, তাহলে সে নিজের আকীকা নিজে করতে পারবে।

মাসয়ালা: কোরবানি বার বার ওয়াজিব হতে পারে এবং ওয়াজিব না হলেও বার বার কোরবানি করার অনুমতি আছে; তবে আকীকা একাধিক বার করার অনুমতি নেই। হাদীস শরীফে একাধিক বার আকীকা করার কথা পাওয়া যায় না। মাসয়ালা: আকীকার গোশতও কোরবানির গোশতের মতো তিন ভাগ করে বিতরণ করা মুস্তাহাব। তবে কেউ যদি ব্যতিক্রম করে, তাহলে কোনো দোষ নেই।

মাসয়ালা: আকীকার গোশত বিনিময় ছাড়া খাওয়ানো বাঞ্ছনীয়। আকীকার গোশত দিয়ে বিয়ের মেহমান খাওয়ানো জায়েয; কিন্তু বিয়ের মেহমানদারি যেহেতু দর কষাকষি করে ঠিক করা হয়, এজন্যে এর মধ্যে বিনিময়ের সন্দেহ থেকে যায়। সুতরাং এমন মেহমানদারিতে আকীকার গোশত

ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত। তবে যেই দাওয়াতে দর কষাকষির নিয়ম নেই, সেই দাওয়াতে আকীকার গোশত খাওয়ানোর সুযোগ আছে। তা ছাড়া আকীকার গোশত দিয়ে বিয়ে-শাদীর মেহমানদারি করার ক্ষেত্রে সপ্তম দিনে আকীকা করার মুস্তাহাব বাদ পড়ার আশঙ্কাও আছে। এ কারণেও কাজটি ছেড়ে দেওয়া উচিত।

মাসয়ালা : অনেক আলেমের মতে কোরবানির চামড়ার যেই গুরুত্ব, আকীকার চামড়ার সেই গুরুত্ব নেই। তবে আকীকার চামড়াও গরিব- মিসকিনকেই দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এর দ্বারা কোনো কাজের বিনিময় দেওয়া উচিত নয়।


ঈদের দিন কবর জিয়ারত করা


ঈদের দিন হচ্ছে আনন্দ ও খুশির দিন। অনেক সময় খুশিতে মানুষ আখেরাতের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে যায়। পক্ষান্তরে কবর যিয়ারত করলে আখেরাতের কথা মনে পড়ে। এজন্যে কোনো ব্যক্তি যদি ঈদের দিন কবর যিয়ারত করে, তাহলে বিষয়টি খুবই উত্তম। এতে কোনো অসুবিধা নেই। তবে বিষয়টি যদি আবশ্যক করে নেওয়া হয় তাহলে তা আমলগত দিক থেকেই হোক না কেন তখন এটি সঠিক ছাড়া কেউ যদি এই দিনে কবর যিয়ারত না করে, তাহলে তাকে তিরস্কার করা বা তাকে তুচ্ছ করা সঠিক নয়। এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান থাকা অবশ্যক। বিষয়ে সাবধান থাকা আবশ্যক।


ঋণ করে কোরবানি করা


কুরবানী ওয়াজিব এমন ব্যক্তিও ঋণের টাকা দিয়ে কুরবানী করলে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। তবে সুদের উপর ঋণ নিয়ে কুরবানী করা যাবে না।


গর্ভবতী পশুর কোরবানি


গর্ভবতী পশু কুরবানী করা জায়েয। জবাইয়ের পর যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায় তাহলে সেটাও জবাই করতে হবে। তবে প্রসবের সময় আসন্ন হলে সে পশু কুরবানী করা মাকরূহ। 

[কাযীখান ৩/৩৫০]


দরিদ্র ব্যক্তির কোরবানি হুকুম


দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কুরবানীর নিয়তে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়।

[বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯২]


যদি আট জন অংশীদার হয়


যদি একটি গরুতে সাত জনের কম ৫/৬ জন শরিক হয় এবং কারো অংশ সাতভাগের কম না হয়; (যেমন, ৭০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনলে কারো অংশে যেন দশ হাজার টাকা কম না হয়) তবে সবার কোরবানি জায়েজ হবে। আর যদি আট জন অংশীদার হয়, কবে কারো কোরবানি বৈধ হবে না।


যদি কোরবানির পশু হারিয়ে যায়


যদি কোরবানির পশু হারিয়ে যায় এবং আরেকটি পশু দ্রুত কেনার পর যদি প্রথম পশুটি পাওয়া যায়, এমতাবস্থায় ক্রেতা যদি সম্পদশালী হয়, তবে যে কোনো একটি পশু কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। আর যদি লোকটি গরিব হয়, তবে দু'টো পশুই কোরবানি করা তার ওপর ওয়াজিব হবে (যার ওপর কোরবানি ওয়াজিবই হয়নি তার জন্য প্রযোজ্য)।


দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে সমান সমান ভাগ করা


সাতজন মিলে অংশীদার হয়ে যদি একটি গরু কোরবানি করে, তবে গোশত নিজেদের ধারণা অনুযায়ী ভাগ করা যাবে না। দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে সমান সমান ভাগ করা উচিত। অন্যথায় যদি ভাগের মধ্যে তারতম্য হয়ে যায়, তবে সুদ হয়ে যাবে এবং গোনাহগার হবে। অবশ্য যদি গোশতের সঙ্গেমাথা, পা বা চামড়াও ভাগ করে দেওয়া হয়, তবে যে ভাগে মাথা, পা, চামড়া থাকবে, সে ভাগে গোশত কম হলেও জায়েজ হবে, যত কমই হোক। কিন্তু যে ভাগে গোশত বেশি সে ভাগে মাথা, পা, বা চামড়া দিলে সুদের মতো হবে এবং গুনাহ হবে।


দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়া পশু


যে পশুর চোখ দু'টি অন্ধ, অথবা একটি চোখ পূর্ণ অন্ধ বা একটি চোখের তিনভাগের একভাগ বা আরও বেশি দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে, তবে সে পশুর কোরবানি জায়েজ নয়। এমনিভাবে যে পশুর একটি কানের বা লেজের এক তৃতীয়াংশ বা তার বেশি কেটে গেছে, সেটিও কোরবানির জন্য জায়েজ নয়।


শিং হয়নি কিংবা শিং ছিল, কিন্তু ভেঙে গেছে


যে পশুর জন্ম থেকে শিং হয়নি কিংবা শিং ছিল, কিন্তু ভেঙে গেছে, তবে এমন পশু দিয়ে কোরবানি জায়েয আছে। অবশ্য যদি একবোরে মূল থেকে ভেঙে যায়, তবে কোরবানি জায়েজ নয়।


চামড়া এমনিতেই দান করে দেওয়া


কোরবানির চামড়া এমনিতেই দান করে দেওয়া মুস্তাহাব (ভালো)। কিন্তু যদি চামড়া বিক্রি করে, তবে এর মূল্য হিসেবে প্রাপ্য ওই টাকাটাই গরিবকে দান করতে হবে। ওই টাকা নিজে খরচ করে যদি অন্য টাকা দান করে, তবে আদায় হয়ে যাবে, কিন্তু অনুত্তম হবে।


কোরবানির চামড়ার দাম


কোরবানির চামড়ার দাম মসজিদ মেরামত বা অন্য কোনো নেক কাজে খরচ করা জায়েজ নয় বরং গরিবকে দান করতে হবে।


নিজের কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা


কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানীদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো।

[মুসনাদে আহমদ ২২৬৫৭, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২২-২২৩, আলমগীরী ৫/৩০০, ইলাউস সুনান ১৭/২৭১-২৭৪]</


কুরবানীর পশু থেকে জবাইয়ের আগে উপকৃত হওয়া


কুরবানীর পশু কেনার পর বা নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে উপকৃত হওয়া জায়েয নয়। যেমন হালচাষ করা, আরোহণ করা, পশম কাটা ইত্যাদি। সুতরাং কুরবানীর পশু দ্বারা এসব করা যাবে না। যদি করে তবে পশমের মূল্য, হালচাষের মূল্য ইত্যাদি সদকা করে দিবে।

[মুসনাদে আহমদ ২/১৪৬, নায়লুল আওতার ৩/১৭২, ইলাউস সুনান ১৭/২৭৭, কাযীখান ৩/৩৫৪, আলমগীরী ৫/৩০০


কোরবানিকৃত পশুর নাজায়েজ সমূহ


যে পশুর গোশত খাওয়া জায়েয, তার সাতটি জিনিস খাওয়া নাজায়েয-

০১. প্রবহমান রক্ত।

০২. প্রস্রাবের রাস্তা।

০৩. অণ্ডকোষ।

০৪. পায়খানার রাস্তা।

০৫. চামড়া ও গোশতের মাঝে সৃষ্ট গোশতের মত গোটা।

০৬. মূত্রথলি।

০৭. পিত্তথলি।


গোশত খাওয়ার বিধিবিধান


কুরবানির গোশত নিজে খাওয়া, ধনী মানুষকে হাদিয়া দেওয়া, ফকিরকে সদকা করা এবং অন্য সময় খাওয়ার জন্যে শুকিয়ে রাখা জায়েয আছে।


নাড়ীভুঁড়ি ও ক্ষুরা খাওয়া


নাড়ীভুঁড়ি ও ক্ষুরা খাওয়া জায়েয; মাকরূহ নয়।


অমুসলিমের জবাইকৃত পশু


জবাইকৃত পশু হালাল হওয়ার জন্যে জবাইকারীর মুসলমান বা আহলে কিতাব হওয়া শর্ত। এ দুইজন ছাড়া অন্যদের জবাইকৃত পশু হালাল নয়। সুতরাং হিন্দু বা শিখ সম্প্রদায়ের বলি হালাল নয়। মুসলিম ও আহলে কিতাব ছাড়া অন্যদের জবাইকৃত পশু হারাম হওয়ার ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম একমত। সুতরাং অগ্নিপূজক, মূর্তিপূজক, যে কোনো ধরনের মুশরিক, নাস্তিক ও মুরতাদের হাতে জবাইকৃত পশু হারাম।


ঈদের নামাযে অতিরিক্ত তাকবীর বলা


দুই ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তাকবীর বলা ওয়াজিব। প্রথম রাকাতে সানার পর সূরা ফাতেহা পড়ার আগে একাধারে তিন তাকবীর বলা, আর দ্বিতীয় রাকাতে কেরাত থেকে ফারেগ হয়ে রুকুতে যাওয়ার আগে তিন তাকবীর বলা ওয়াজিব।

[ফাতাওয়া হিন্দিয়া: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৫০-১৫১, রদ্দুল মুহতার: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৭২-১৭৪]


যৌথ সম্পত্তির কোরবানি


চার ভাইয়ের ব্যবসা একসাথে। চারজন সমান অংশের মালিক। যদি এই চারজনের যৌথ সম্পত্তি এতটা মূল্যবান হয় যে, করজ আদায় করে দেওয়ার পর প্রত্যেকের অংশ নেসাব পরিমাণ হবে, তাহলে এই চারজনের মধ্যে যারা বালেগ, তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। প্রত্যেকের কমপক্ষে একটি ছাগল বা গরু-মহিষের একসপ্তমাংশ কোরবানি করতে হবে।


যৌথ সম্পদের পক্ষ থেকে একটি ছাগল বা গরু-মহিষের একসপ্তমাংশ কোরবানি করে দেওয়া যথেষ্ট নয়। একটি ছাগল যদি দুইজনের পক্ষ থেকে কোরবানি করা হয়, তাহলে কোরবানি ওয়াজিব হোক অথবা নফল- জায়েয হবে না এবং তা কোরবানিও হবে না।

[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ৭/১০৫, কেফায়াতুল মুফতী: ৮/১৭৬]


অন্যের পক্ষ থেকে কোরবানি আদায়


নিয়ম হচ্ছে, যে ব্যক্তি নেসাবের মালিক, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এই ওয়াজিব আদায়ের ব্যবস্থা তার নিজেরই করার কথা এবং উত্তমও তা-ই। কিন্তু নেসাবের মালিক হওয়া সত্ত্বেও কোনো ওজরের কারণে কেউ যদি কোরবানির ব্যবস্থা করতে না পারে, তাহলে সে নিজের পক্ষ থেকে কোরবানি করার জন্যে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেবে। তার অনুমতি নিয়ে অন্য কেউ যদি তার কোরবানি আদায় করে দেয়, তাহলে তার কোরবানি সহীহ হবে। তবে অনুমতি ছাড়া কেউ যদি তার পক্ষ থেকে কোরবানি করে দেয়, তাহলে তার ওয়াজিব কোরবানি আদায় হবে না।

[আল-মাবসূত: ১৪/১৮৪]


যৌথ পরিবারের কোরবানি


এক ব্যক্তির পাঁচ ছেলে। সবাই প্রাপ্তবয়স্ক, সবাই অর্থ উপার্জন করে পিতার হাতে জমা দেয়। এখানে সবার অর্থ মিলিয়ে একটি নেসাব সাব্যস্ত হবে। যদি সব মিলিয়ে কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার নেসাব পূর্ণ হয়, তাহলে পিতার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে।


পিতার কাছে অর্থ জমা দেওয়া সত্ত্বেও যদি কোনো ছেলে নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়, তাহলে তার ওপর আলাদাভাবে কোরবানি ওয়াজিব হবে। অবশ্য পিতা যদি তার অনুমতি নিয়ে কোরবানি করে দেন, তাহলে উক্ত ছেলের কোরবানি আদায় হয়ে যাবে।


কোরবানি কবুল হওয়ার শর্ত


যে কোনো ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্যে কিছু শর্ত আছে। কোরবানিও একটি ইবাদত। এই ইবাদতও কবুল হওয়ার জন্যে কিছু শর্ত আছে। শর্তগুলো নিম্নরূপ-

০১. কোরবানি দাতার মুত্তাকী হওয়া।

০২. কোরবানি শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে করা।


০৩. হালাল মাল দ্বারা কোরবানি করা।


০৪. আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী যথাযথভাবে কোরবানি করতে না পারার কারণে অনুতপ্ত হওয়া এবং নিজের অক্ষমতা স্বীকার করা।

০৫. কোরবানি করতে গিয়ে ভুলত্রুটি হওয়ার আশঙ্কায় আল্লাহর পাকড়াওকে ভয় করা।

০৬. লোক দেখানোর অভিপ্রায় যেন কোরবানি বরবাদ করে না দেয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা।


পশু কিনে যদি কোরবানি করতে না পারে


কারো ওপর কোরবানি ওয়াজিব ছিল; কিন্তু কোরবানির তিন দিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও কোরবানি করতে পারেনি, তাহলে একটি ছাগল বা ভেড়ার মূল্য সদকা করে দিবে। যদি পশু কিনে থাকে, তাহলে সেই পশুটিই সদকা করে দিবে।

[রাদ্দুল মুহতার: ২৬/২৩৫]

মাসয়ালা : কোরবানির পশু খরিদ করা সত্ত্বেও যদি ঈদের তিন দিনে কোরবানি করতে না পারে, তাহলে ধনী হোক অথবা গরিব, কোরবানি নফল, ওয়াজিব হোক কিংবা মানতের, সর্বাবস্থায় ওই পশু সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব। ১৮৪ যদি মাসয়ালা না জানার কারণে ঈদের তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর উক্ত পশু জবাই করে, তাহলে সেটার গোশত গরিবদের মধ্যে সদকা করে দিবে; কোনো ধনী ব্যক্তিকে এর গোশত দেয়া যাবে না; নিজেও খাওয়া যাবে না।

[রাদ্দুল মুহতার: ২৬/২৩৫]


ক্রয়ের পর কোরবানির পশু মারা গেলে


কোরবানির উদ্দেশ্যে পশু খরিদ করার পর যদি সেই পশু কোরবানি করার আগেই মারা যায় এবং ক্রেতা গরিব হয়, তাহলে তার কোরবানি রহিত হয়ে যাবে। নতুন করে পশু খরিদ করে কোরবানি করা তার জন্যে ওয়াজিব নয়। আর যদি ক্রেতা ধনী হয়, তাহলে তার কোরবানি রহিত হবে না; আরেকটি পশুর ব্যবস্থা করে কোরবানি করতে হবে।

[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ১১৮]


গোশত বিক্রির উদ্দেশ্যে কোরবানিতে অংশগ্রহণ


সাতজন মিলে গরু কেনার পর জানা গেল, তাদের মধ্য থেকে একজন হচ্ছে কসাই। তার উদ্দেশ্য কোরবানিতে অংশ নিয়ে সেই গোশত বিক্রি করে দেওয়া। তাহলে এই ব্যক্তির অংশ কোরবানির নিয়ত আছে এমন এক ব্যক্তি কিনে নেবে, তারপর কোরবানি করবে; অন্যথায় সবার কোরবানি খারাপ হয়ে যাবে। কারো কোরবানি সঠিক হবে না।

[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ১১০, ফাতাওয়া মাহমুদিয়া: ২/৩১১]


জবাইয়ের পর শরীক


যদি সাতজন শরীক হয়ে একটি গরু কিনে এবং কোরবানির দিন জবাই করে। এরপর একজন এসে বলে, আমাকে শরীক করো। তখন এক শরীক তার কাছ থেকে মূল্য নিয়ে নেয় এবং নিজের অংশ তাকে দিয়ে দেয়, তাহলে জায়েয হবে না। কোরবানি জবাই হয়ে যাওয়ার পর পরিবর্তন জায়েয নয়।

[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি: ১১০, আযীযুল ফাতাওয়া: ১/৭১৯]


শরীক গ্রহণের উত্তম পন্থা


কোরবানির পশু খরিদ করার আগেই শরীক নির্দিষ্ট করে নেওয়া হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। যদি এই নিয়তে খরিদ করে যে, পরবর্তীতে কাউকে পাওয়া গেলে শরীক করে নেবে, তাহলেও জায়েয।


যদি নিয়ত ছাড়া পশু খরিদ করে এবং পরবর্তীতে কয়েক জনকে শরীক করে, তাহলে জায়েয হওয়া-না হওয়ার ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। তবে অগ্রাধিকারযোগ্য অভিমত হলো, জায়েয হবে।

[মাসায়েলে ঈদাইন ও কোরবানি ১০৯ , কেফায়াতুল মুফতী: ৮/১৮৮]


নিয়ত ছাড়া পণ্ড ক্রয় ও কোরবানি


পশু খরিদ করার সময় যদি কুরবানির নিয়ত না করা হয়, তাহলেও পরবর্তীতে কুরবানির নিয়তে সেটা জবাই করা যাবে এবং কুরবানিও সহীহ হবে। তা ছাড়া খরিদ করার সময় নিয়ত না করে যদি পরে কুরবানির নিয়ত করে, তাহলে সেটা কুরবানির জন্যে নির্দিষ্ট হবে না। ধনী-গরিব যে কোনো ব্যক্তি উক্ত পশু বাদ দিয়ে অন্য কোনো পশু কুরবানি করতে পারবে।

[বাদায়ে' সানায়ে': ১০/২৬৯ ১৪৬, রাদ্দুল মুহতার: ২৬/২১১]


হালাল ও হারাম মিশ্রিত সম্পদের কোরবানি


কারো অধিকাংশ সম্পদ যদি হালাল হয় এবং সে নেসাবের মালিক হয়, তাহলে তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে। আর যদি কারো অধিকাংশ সম্পদ হারাম হয় এবং সে নেসাবের মালিক হয়, তাহলেও তার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে না।

[রাদ্দুল মুহতার ১৯/৩৭১ ১৩৪, ফাতহুল কাদীর ৩/৪৭৫]


জামানতের টাকার ওপর কোরবানি


দোকান বা বাড়ি ভাড়া নেওয়ার সময় অথবা জমি বন্ধক রাখার সময় মোটা অংকের জামানত দিতে হয়। ভাড়া বা বন্ধক গ্রহণকারী অপর পক্ষকে এই অর্থ দিয়ে থাকে। শরীয়তের দৃষ্টিতে জামানতের এই অর্থ ঋণ হিসেবে গণ্য। আর প্রদত্ত ঋণ যদি নেসাব পরিমাণ হয় এবং কুরবানির দিনগুলোতে পাওয়া যায়, তাহলে কুরবানি ওয়াজিব হবে। আর যদি এই ঋণ নেসাব পরিমাণ না হয় এবং নেসাব হওয়ার মতো অন্য সম্পদও না থাকে, অথবা কুরবানির দিনগুলোতে এই ঋণ ফেরত পাওয়া না যায়, তাহলে ঋণদাতার ওপর কুরবানি ওয়াজিব হবে না।


পেনশনের অর্থ দিয়ে কোরবানি


চাকরিজীবীদেরকে অবসরে যাওয়ার পর সরকার বা কোম্পানীর পক্ষ যে পেনশন বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেওয়া হয়, তা হালাল। এই তহবিল সাধারণত গঠন করা হয়, চাকরিজীবীর আংশিক বেতন কেটে; কর্তিত বেতন সুদে খাটিয়ে এবং সরকার বা কোম্পানীর পক্ষ থেকে কিছু ভর্তুকি দিয়ে। অবসরে গমনকারী চাকরিজীবীর পক্ষে হিসাব করে সুদের পয়সা আলাদা করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া এখানে তার ইচ্ছাও কাজ করে না এবং তারই বেতন কেটে রাখা হয়। সেই বেতন কোনো হালাল খাতে বিনিয়োগ করার সম্ভাবনাও আছে। এজন্যে মুফতী সাহেবদের মতে পেনশন ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের অর্থ হালাল। আর হালাল মাল দিয়ে কুরবানি জায়েয হওয়ার ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই।

[রাদ্দুল মুহতার। ১৯/৩৭১]


ব্যাংকের সুদ দিয়ে কোরবানি


ব্যাংক থেকে যে মুনাফা, লাভ বা প্রফিট দেওয়া হয়, তা নিঃসন্দেহে সুদ। কুরআন ও হাদীসের অকাট্য বক্তব্য অনুসারে সুদ হারাম। এমন কি নিকৃষ্টতর হারাম। আর যে কোনো প্রকারের হারাম অর্থ দিয়ে নেক কাজ করাও হারাম। সুতরাং চুরি, ডাকাতি, সুদ, ঘুষসহ যে কোনো ধরনের হারাম পয়সা দিয়ে কুরবানি করা নাজায়েয ও হারাম। ব্যাংকে সঞ্চিত সুদ উত্তোলন করে সাওয়াবের নিয়ত ছাড়া কোনো ফকির-মিসকিন বা মাদরাসার দরিদ্র তহবিলে প্রদান করা বাঞ্ছনীয়।


ঈদের দিন গান-বাজনা করা


আজকাল ঈদের সাথে নতুন এক অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে। তা হচ্ছে ঈদ উপলক্ষে গান-বাজনা করা। মুসলমানের জীবন পুরোটা ইবাদত-বন্দেগি দিয়ে পরিবেষ্টিত। এখানে স্বেচ্ছাচারিতার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং ঈদের আনন্দও ইবাদতের মাধ্যমে উদযাপিত হয়। এর অর্থ হচ্ছে মুসলমান ঈদের দিনও ইবাদতে মগ্ন থাকবে। কিন্তু কেউ যদি ইদের দিন মনকে প্রফুল্ল করার জন্যে ইবাদতের বাইরে কিছু করতে চায়, তাহলে সর্বোচ্চ সে মুবাহ কাজ করতে পারে। এই সীমা অতিক্রম করার অনুমতি শরীয়ত প্রদান করেনি।

পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে আয়োজিত গান-বাজনার দিকগুলো নম্বর দিয়ে উল্লেখ করছি-

০১. গান (কবীরা গুনাহ)।

০২. বাজনা (কবীরা গুনাহ)।

০৩. নাচ (কবীরা গুনাহ)।

০৪. নারী-পুরুষের পর্দা লঙ্ঘন (কবীরা গুনাহ)।

০৫. মানুষের ঘুমে বিঘ্ন সৃষ্টি (কবীরা গুনাহ)।

০৬. অসুস্থ ও রোগীদের অস্বস্তি সৃষ্টি (কবীরা গুনাহ)।

০৭. প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়া (কবীরা গুনাহ)

০৮. মাদকদ্রব্য সেবন (কবীরা গুনাহ)।

০৯. (সম্ভাবনার ক্ষেত্রে) যেনা (কবীরা গুনাহ)।

১০. নামাজ ছেড়ে দেয়া (কবীরা গুনাহ)।

এখানে অন্যসব প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে শুধু গান-বাজনা সম্পর্কে আলোচনা করছি। হাদীস শরীফে গান-বাজনা সম্পর্কে কঠিন হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। আনাস (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে নবী (সা.)বলেন-

صَوْتَانِ مَلْعُونَانِ فِي الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ مِزْمَارٌ عِنْدَ نِعْمَةٍ، وَرَنَّةٌ عِنْدَ مُصِيبَةٍ

দুটি আওয়াজ দুনিয়া ও আখেরাতে অভিশপ্ত

১. আনন্দের সময় বাঁশির আওয়াজ।

২.দুঃখের সময় চিৎকারের আওয়াজ।

[কানযুল উম্মাল - ৪০৬৭২]


ঈদের দিন মিষ্টিমুখ করা


আমাদের দেশের মানুষ ঈদের দিন লাচ্ছা সেমাই, পায়েশ, ফিরনি ইত্যাদি রান্না করা জরুরি মনে করে। শরীয়তের দৃষ্টিতে এসবের কোনো গুরুত্ব নেই। কারো ইচ্ছা হলে কোনো মিষ্টান্ন রান্না করতে পারে, তবে এতে সাওয়াব আছে মনে করা উচিত নয়। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে মিষ্টান্ন পাঠানো, শিশুদেরকে খাওয়ানো, এরপর এগুলো বিনিময় করা এবং সামর্থ্য না থাকলে ঋণ নিয়ে এসবের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বাধ্যবাধকতা অপচয়ের শামিল। এতে কষ্টও হয়। এজন্যে এগুলো বর্জন করা বাঞ্ছনীয়। কোরবানির ঈদের দিনও এমন বন্দোবস্ত হয়ে থাকে। তাও ভিত্তিহীন। উভয় ঈদের হুকুম অভিন্ন। কোরবানির পশুর নির্দিষ্ট কোনো অংশ কাউকে দেওয়া জরুরি মনে করাও যুক্তিহীন প্রথা। অথচ এমন প্রচলনও কোনো কোনো এলাকায় লক্ষ করা যায়। এগুলো সবই বর্জনীয়।



Post a Comment

نموذج الاتصال