কোরবানির নিয়ম

 মুসাফির ও মহিলাদের কোরবানি করা

حَدَّثَنَا مُسَدَّدٌ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ الْقَاسِمِ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم دَخَلَ عَلَيْهَا وَحَاضَتْ بِسَرِفَ، قَبْلَ أَنْ تَدْخُلَ مَكَّةَ وَهْىَ تَبْكِي فَقَالَ ‏"‏ مَا لَكِ أَنَفِسْتِ ‏"‏‏.‏ قَالَتْ نَعَمْ‏.‏ قَالَ ‏"‏ إِنَّ هَذَا أَمْرٌ كَتَبَهُ اللَّهُ عَلَى بَنَاتِ آدَمَ، فَاقْضِي مَا يَقْضِي الْحَاجُّ غَيْرَ أَنْ لاَ تَطُوفِي بِالْبَيْتِ ‏"‏‏.‏ فَلَمَّا كُنَّا بِمِنًى أُتِيتُ بِلَحْمِ بَقَرٍ،

মুসাদ্দাদ (রাঃ) ... আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কাছে প্রবেশ করলেন। অথচ মক্কা প্রবেশ করার পূর্বেই সারিফ নামক স্থানে তার মাসিক শুরু হল। তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তোমার কি হয়েছে? মাসিক শুরু হয়েছে না কি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ এটা তো এমন এক বিষয় যা আল্লাহ আদম (আলাইহিস সালাম) এর কন্যা সন্তানের উপর নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং তুমি আদায় করে যাও, হাজীগণ যা করে থাকে, তুমিও অনুরুপ করে যাও। তবে তুমি বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করবে না। এরপর আমরা যখন মিনায় ছিলাম, তখন আমার কাছে গরুর গোশত নিয়ে আসা হল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এটা কি? লোকজন উত্তর করলো রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীদের পক্ষ থেকে গরু কোরবানি করেছেন।

[সহীহ বুখারী: ৫১৫০]


কোরবানির সাথে ভাগে আকিকা দেয়া 

কোরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে। ছেলের জন্য দুই অংশ আর মেয়ের জন্য এক অংশ দিতে হবে।

শৈশবে আকীকা করা না হলে বড় হওয়ার পরও আকীকা করা যাবে। যার আকীকা সে নিজে এবং তার মা-বাবাও আকীকার গোশত খেতে পারবে।

[ইলাউস সুনান ১৭/১২৬]

কেউ কেউ কোরবানির পশুর সাথে আকীকা দিলে আকীকা সহীহ হবে না বলে মত দেন। কিন্তু নির্ভরযোগ্য আলেমগণ এ মতটি গ্রহণ করেননি। কোনো হাদীসে কোরবানির সাথে আকীকা করতে নিষেধ করা হয়নি; বরং কোরবানির সাথে


জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ বলা

শরীয়তের দৃষ্টিতে যেসব পশু হালাল, সেগুলো খাওয়া জায়েয হওয়ার জন্যে জবাই শর্ত। আর জবাই সহীহ হওয়ার জন্যে বিসমিল্লাহ বলা শর্ত। যদি কেউ জবাইয়ের সময় ইচ্ছা করে বিসমিল্লাহ ছেড়ে দেয়, তাহলে পশু মুরদার সাব্যস্ত হবে এবং সেটা খাওয়া জায়েয হবে না।

মাসয়ালা: কোনো মুসলমান জবাই করার সময় যদি বিসমিল্লাহ বলার কথা ভুলে যায়, তাহলেও তার জবাইকৃত পশু খাওয়া জায়েয।

মাসয়ালা: স্বাভাবিক জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ আর জবাই একসঙ্গে হওয়া জরুরি। অর্থাৎ, বিসমিল্লাহ পড়তে পড়তে জবাই করবে। বিসমিল্লাহ পড়ার পর জবাইয়ের আগে আর কোনো কাজ করবে না। যদি কেউ ছাগল শোয়ায়ে বিসমিল্লাহ পড়ে, তারপর সেই ছাগল ছেড়ে দেয়। এরপর আরেকটি ছাগল এনে ঐ বিসমিল্লাহর ওপর জবাই করে, তাহলে জবাইকৃত পশু খাওয়া জায়েয হবে না।

মাসয়ালা: জবাইয়ের কাজে যতজন শরীক হয়, সবারই বিসমিল্লাহ বলা জরুরি নয়। যে ব্যক্তি ছুরি চালায়, সে বিসমিল্লাহ বললেই যথেষ্ট। অবশ্য যে ব্যক্তি ছুরি চালানোর কাজে সহায়তা করে, তারও বিসমিল্লাহ বলা আবশ্যক।

মাসয়ালা : অনেকে কোরবানির জন্যে দোয়া পড়া খুব জরুরি মনে করে। কিতাবাদিতে কোরবানির দোয়া লেখা আছে; কিন্তু সেই দোয়া পাঠ করা মুস্তাহাব। ঐ দোয়া না পড়লেও কোরবানি সহীহ হবে।

মাসয়ালা: কোরবানির নিয়ত মনে মনে করাই যথেষ্ট; মুখে বলা জরুরি নয়। শুধু জবাইয়ের সময় মুখে 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার' বলা জরুরি।

মাসয়ালা : শুধু 'আল্লাহু আকবার' বলে জবাই করলেও পশু হালাল হবে। শুধু 'বিসমিল্লাহ' বললেও হালাল হবে। তবে 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার' বলা সুন্নাত।

মাসয়ালা: 'বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম' বলে জবাই করলেও পশু হালাল হবে। তবে পশু জবাইয়ের পরিবেশ দয়া ও অনুগ্রহের পরিপন্থী। এজন্যে 'রাহমান' ও 'রাহীম' যোগ করে বলা সমীচীন নয়।

মাসয়ালা: যদি 'খাজা বাবা আল্লাহু আকবার' অথবা 'বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার খাজা বাবা জিন্দাবাদ' বলে কোনো পশু জবাই করা হয়, তাহলে সেই পশু খাওয়া জায়েয হবে না।


জবাইয়ের সরঞ্জাম

ছুরি, চাকু, তলোয়ার, বাঁশের নেইল ও ধারালো পাথর দ্বারা পশু জবাই করা জায়েয। শর্ত হচ্ছে বস্তুটিতে রগ কাটার ধার থাকতে হবে এবং রগ কেটে প্রবহমান রক্ত বের করতে হবে। তবে দাঁত ও নখ দিয়ে জবাই করা জায়েয নয়।

মাসয়ালা: ধারালো বস্তু দিয়ে রগ না কেটে কোনো ভারী জিনিস দ্বারা জখম করলে পশু হালাল হবে না। জখম থেকে যদি রক্ত বেরও হয়, তবুও জায়েয হবে না।

মাসয়ালা: গলায় চারটি রগ আছে- শ্বাসনালি, খাদ্যনালি আর দুটি রক্তনালি। এই চারটি রগের অন্তত তিনটি কাটা ফরয। একটি বা দুটি কাটলে পশু হালাল হবে না।

মাসয়ালা: পাক জায়গায় পশু জবাই করা বাঞ্ছনীয়। নাপাক স্থানে পশু জবাই করা উচিত নয়।

মাসয়ালা: ধারালো পাথর ও বাঁশের নেইল দ্বারা জবাই করার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের নেই। এজন্যে এগুলো দিয়ে পশু জবাই করতে গিয়ে খামোখা পশুকে কষ্ট দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করা বোকামি সাব্যস্ত হবে।


কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম

কোরবানির পশু জবাই করার নিয়ম এবং উত্তম উপায়: 

কোরবানি দাতা যদি নিজে জবাই করার সাহস রাখে এবং জবাইয়ের হুকুম- আহকাম সম্পর্কে অবগত থাকে, তাহলে নিজের পশু নিজ হাতে কোরবানি করাই উত্তম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের কোরবানি নিজ হাতে জবাই করতেন। হাদীসে আছে, আনাস (রাঃ) বলেন-

نَحَرَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِيَدِهِ سَبْعَ بُدْنٍ قِيَامًا وَضَحَى بِالْمَدِينَةِ كَبُشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ

রাসূল (সাঃ) নিজ হাতে সাতটি উট দাঁড় করিয়ে নহর (কোরবানি) করেছেন। আর মদিনায় দুটি মোটাতাজা শিংবিশিষ্ট ভেড়া কোরবানি করেছেন।

[বুখারী: হাদীস- ১৭১৪] 

নিজের কোরবানি নিজ হাতে জবাই করার সামর্থ্য না থাকলে উপস্থিত থেকে কাউকে দিয়ে জবাই করানো ভালো।

আবু সাঈদ খুদরী থেকে বর্ণিত হাদীসে আছে-

قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِفَاطِمَةَ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهَا : قُوْمِي إِلَى أُضْحِيَّتِكِ فَاشْهَدِيْهَا فَإِنَّ لَكِ بِأَوَّلِ قَطْرَةٍ تَقْطُرُ مِنْ دَمِهَا يُغْفَرُ لَكِ مَا سَلَفَ مِنْ ذُنُوبِكِ قَالَتْ : يَا رَسُولَ اللهِ هَذَا لَنَا أَهْلِ الْبَيْتِ خَاصَّةً أَوْ لَنَا وَلِلْمُسْلِمِينَ عَامَّةً؟ قَالَ : بَلْ لَنَا وَلِلْمُسْلِمِينَ عَامَّةً

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ফাতেমা (রাঃ)-কে বললেন, তুমি তোমার কোরবানির সামনে যাও এবং কোরবানি প্রত্যক্ষ করো। কেননা, কোরবানির রক্তের প্রথম ফোঁটা যখন পড়বে, তখনই তোমার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। ফাতেমা (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কি বিশেষভাবে আমাদের পরিবারের জন্যে, নাকি ব্যাপকভাবে আমাদের ও সমস্ত মুসলমানের জন্যে? নবীজি বললেন, ব্যাপকভাবে আমাদের ও সমস্ত মুসলমানের জন্যে। 

[হাকেম: হাদীস নং- ৭৫২৫] 

উপস্থিত না থেকেও অন্যের মাধ্যমে কোরবানির পশু জবাই করানো জায়েয; কিন্তু নিজে জবাই করলে, অথবা জবাইয়ের সময় নিজে উপস্থিত থাকলে যে আগ্রহ, আন্তরিকতা এবং আল্লাহ তায়ালার জন্যে যে মহব্বত অন্তর্ভুক্ত থাকে, তৃতীয় পন্থায় তা পুরোপুরি থাকে না। এজন্যে কোরবানির উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়।

জবাইয়ের সময় লক্ষণীয় কিছু বিষয়:

একটি হাদীসে আছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন-

إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ الإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الدُّبْحَةَ وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ وَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ

নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সবকিছুর ওপর অনুগ্রহ করাকে ফরয করে দিয়েছেন। সুতরাং যদি হত্যা করতে বাধ্য হও, তাহলে উত্তম পন্থায় হত্যা করো। যদি তোমাদের কোনো পশু জবাই করতে হয়, তাহলে উত্তম পন্থায় জবাই করো। ছুরি ধার করে নিয়ো, যাতে যথাসম্ভব পশুকে স্বস্তি দেওয়া যায়। 

[মুসলিম: হাদীস- ৫১৬৭]

মাসয়ালা: কসাইরা পশু জবাই করার পর ঠান্ডা হতে দেয় না; চামড়া খোলা শুরু করে দেয়। এই কাজটি হারাম। মনে রাখতে হবে, জবাইয়ের পর পশু পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে গেলে চামড়া খুলতে হবে।

পশু জবাই করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলেই জবাইয়ের সময় পশুর সাথে যেনতেন আচরণ উচিত নয়। পশুকে ভীতসন্ত্রস্ত করা, শোয়ানোর পর টেনে-হিঁচড়ে এদিক-সেদিক নেওয়া, পা ধরে টানাটানি করা, ছোট পশুর উপর বিনা প্রয়োজনে চড়ে বসা, পশু শোয়ানোর পর জবাই করতে বিলম্ব করা ইত্যাদি নির্দয় আচরণের শামিল। এজন্যে জবাইয়ের সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি খুব খেয়াল রাখা চাই-

• জবাইয়ের আগে স্বাভাবিকভাবে পশুকে দানাপানি খাওয়াতে থাকবে। পশুকে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত রাখা মাকরূহ

• টেনে-হিঁচড়ে জবাইয়ের স্থানে নিয়ে যাওয়া মাকরূহ।

• পরিপূর্ণ প্রস্তুতির সাথে সহজভাবে পশুকে জমিনে ফেলবে। অনর্থক কঠোরতা করা মাকরূহ।

• বাম কাতে কেবলামুখী করে শোয়াবে, যাতে খুব সহজে জান বের হতে পারে। এর খেলাফ করা মাকরূহ।

• বড় পশুর চার পা থেকে তিন পা বেঁধে নিবে।

• আগেই ছুরি ধার দিয়ে নিবে। ভোঁতা ছুরি দিয়ে জবাই করা মাকরূহ।

• ছুরি যদি ধার দিতে হয়, তাহলে পশু থেকে আড়ালে ধার দিবে। কেননা, পশুর সামনে ছুরি ধার করা মাকরূহ।

• শোয়ানোর আগেই ছুরি ধার করে নিবে। পশু শোয়ানোর পর ছুরি ধার করা মাকরূহ।

• এক পশুর সামনে অপর পশু জবাই করা মাকরূহ।

• এত জোরে ছুরি চালানো উচিত নয় যাতে, মাথা আলাদা হয়ে যায়, অথবা ঘাড়ের মধ্যকার হারাম মগজ (সাদা রগ) পর্যন্ত ছুরি চলে যায়। এমনটা করা মাকরূহ।

• ঘাড়ের উপর থেকে জবাই করা মাকরূহ ও নিষিদ্ধ। কেননা, এভাবে অনর্থক পশুকে কষ্ট দেওয়া হয়।

• জবাইয়ের পর পশু ঠান্ডা হওয়ার আগে মাথা কেটে আলাদা করা বা চামড়া খুলতে শুরু করা মাকরূহ।

এসব বিষয় শুধু কোরবানির পশুর সাথে বিশিষ্ট নয়; বরং যে কোনো পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে এসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়। 


কোরবানি দেওয়া পশুর মাংস বন্টন

কোরবানির গোশত নিজে খাবে, আত্মীয়স্বজনকে দেবে এবং ফকির মিসকিনকে খয়রাত করবে কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ খয়রাত করা উত্তম এক্ষেত্রে ত্রুটি করা উচিত নয় তবে কেউ যদি সামান্য খয়রাত করে, তা হলেও কোনো গুনাহ হবে না

মাসয়ালা: বড় পশুতে যদি একাধিক ব্যক্তি শরীক হয়, তাহলে গোশত অনুমান করে ভাগ করবে না; বরং দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে খুব সতর্কতার সাথে ভাগ করবে। কোনো কমবেশি হলে সেটুকু সুদ হয়ে যাবে এবং গুনাহ হবে। তবে গোশতের সাথে যদি কল্লা, পায়া ও চামড়া ইত্যাদিও ভাগ করে, তাহলে কোনো ভাগে গোশত কম গিয়ে উল্লিখিত বস্তুগুলো যদি বেশি যায় এবং ওজনে সমান হয়, তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। কেউ যদি কল্লা বা পায়া বেশি নেয়, তাহলেও সুদ হয়ে যাবে এবং গুনাহ হবে।

Post a Comment

نموذج الاتصال